
শ্যামল চৌধুরী
সারাবিশ্বের মতো কোভিড-১৯ নামের সংক্রামক রোগের প্রকোপে যখন ধুঁকছে জাতি, সকরুণ বাস্তবতার মুখোমুখিতে জাতি যখন চরম বিষাদগ্রস্থ, সেই সময়ে চিরবিদায় নিলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। যার প্রয়াণে দেশের শীর্ষস্থানীয় লেখক, অধ্যাপক ও সংস্কৃতিকর্মীদের কথায় প্রকাশিত হয়েছে ‘অভিভাবক’ হারানোর বেদনা।
গত ১৪ মে ২০২০, বৃহস্পতিবার না ফেরার দেশে পাড়ি জমান বর্ষীয়ান বুদ্ধিজীবি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক, ডক্টর আনিসুজ্জামান। ৮৩ বছর বয়সে তাঁর এই চলে যাওয়া বৈশ্বিক সংকটকালে হলেও নিজের পৃথিবীকে সাজিয়েছেন তিনি বিপুল ঐশ্বর্যে। তাঁর সমগ্র জীবনে ঈর্ষণীয় সব সাফল্য ও গৌরবগাঁথায় আজ তিনি উদ্ভাসিত। সেই অর্থে একটি পূর্ণ জীবনই তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু যদি তাঁর জীবনকে দেখি তাঁর কাছ থেকে আমাদের প্রাপ্তির নিরিখে, আমাদের আকাক্সক্ষার নিরিখে, মনে হয় আরও কিছুদিন থেকে গেলেও পারতেন! আজ তাঁর ৫ম মৃত্যুবার্ষিকীতে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।
বাংলার অধ্যাপকের পরিচয় ছাপিয়ে সাহিত্য-গবেষণা, লেখালেখি, সাংগঠনিক কার্যক্রম ও দেশ-জাতির নানা সংকটকালে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যের জন্য অনন্য চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অনেকের চোখে তিনি ছিলেন ‘আলোকবর্তিকা’। মহান ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ছিলেন অগ্রসৈনিক। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার আনিসুজ্জামানের হাত ধরেই এসেছে বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা সংস্করণ। যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে সোচ্চার আনিসুজ্জামান ছিলেন ১৯৯১ সালে গঠিত গণআদালতে অভিযোগকারীদের একজন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেছেন আনিসুজ্জামান। আমৃত্যু তিনি ছিলেন বাংলা একাডেমির সভাপতি। দীর্ঘ কর্মজীবনে শিক্ষকতা, গবেষণা ও মৌলিক সাহিত্য রচনার পাশাপাশি একক ও যৌথভাবে অসংখ্য গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ভাষা ও শিক্ষায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৭০ সালে পান ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’, ১৯৮৫ সালে সরকার তাকে ‘একুশে পদক’ ভূষিত করে; সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তিনি পান ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’। ভারত সরকার ২০১৪ সালে তাকে ‘পদ্মভূষণ পদক’ ভূষিত করে। ২০১৮ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ সরকার জামিলুর রেজা চৌধুরী ও রফিকুল ইসলামের সঙ্গে আনিসুজ্জামানকেও জাতীয় অধ্যাপক ঘোষণা করে। এছাড়াও ২০০৫ সালে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি প্রদান করে।
একজন সমাজ হিতৈষী, গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল চেতনা, সুশীল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও অনন্য স্বভাবমাধুর্যের স্নিগ্ধতা দিয়ে তিনি নিজেকে পরিণত করেছিলেন দেশের অগ্রগণ্য মণীষায়। অর্ধ শতকের বেশি সময় ধরে বাঙালিকে ঋদ্ধ করে যাওয়া অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের পথচলা শেষ হল নজিরবিহীন এক সংকটের কালে।
আনিসুজ্জামান স্যার একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাতিঘর, সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। অনেকের মতো তাঁর সান্নিধ্য পেতে আমারও প্রবল আকাক্সক্ষা ছিল। খুব সম্ভবত ২০০৭ সালের প্রথম দিকে সে আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত আমার কিছু লেখার নিয়ে বই করার অভিপ্রায়ে তাঁর উপদেশ-পরামর্শ পাওয়ার জন্য মনে খুব প্রবল তাগিদ অনুভব করছিলাম সে সময়। আমার অকৃত্রিম শুভাকাঙ্ক্ষী প্রিয় ব্যক্তিত্ব চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী পত্রিকার বর্তমান যুগ্ম সম্পাদক, শিশু সাহিত্যিক-সাংবাদিক রাশেদ রউফ ভাইয়ের কাছ থেকে তাঁর মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করলাম। রাশেদ ভাইকে শুধু বলেছি, আমাকে আনিসুজ্জামান স্যারের নাম্বারটা একটু দিবেন? একবারো তিনি জিজ্ঞেস করেননি, কেন কি কাজে দরকার তাঁকে? শুধু বললেন, তুমি আগে তাঁর মোবাইলে তোমার পরিচয় দিয়ে এসএমএস করবে, পরে ফোন দিয়ে কথা বলবে। রাশেদ ভাই এর সাহস জাগানিয়া পরামর্শে স্যারকে প্রথমে মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তা দেয়ার পর ফোন দিয়ে বললাম, আমি একটু আপনার সাথে দেখা করতে চাই। আমার একটা বই প্রকাশ এর ব্যাপারে আপনার পরামর্শ চাই। অকপটেই তিনি তাঁর বাসার ঠিকানা আমাকে জানালেন। বললেন, ‘যখনই আসবে ফোন দিয়ে আসবে’। বাসা ছিল ঢাকার গুলশানে। একদিন ফোন দিলে তিনি আমাকে ওইদিন বিকেল ৪টায় যেতে বলেন। বাসার দরজায় গিয়ে বুকটা ধুরু ধুরু করছে, ভাবছি এমন একজন বড় মাপের ব্যক্তিত্বের দোরগোড়ায় আজ আমি আসতে পারলাম! দরজায় বড় করে নেমপ্লেট আছে ‘আনিসুজ্জামান’। নামের আগে পিছে আর কিছুই লিখলেন না, অধ্যাপক বা ডক্টর কিছুই না! কলিং বেল দিয়ে ঢুকতেই একজন দরজা খুলে নিয়ে গেলেন ড্রয়িং রুমে। ড্রয়িং রুম তো নয় যেন বিশাল একটা লাইব্রেরি। মূল দরজা থেকে ড্রয়িং রুমটা একটু ভেতরে। ড্রয়িং রুম পর্যন্ত যেতে যেতে যতই চোখ পড়ছে, শুধু বুক সেলফে থরে থরে সাজানো বই আর বই। মাঝে একটা টেবিলে কিছু বই এলোমেলো হয়ে আছে। তখন আমার সেই শোনা কথা মনে পড়ে গেল, আনিসুজ্জামান স্যার যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগদানের উদ্দেশ্যে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন তখন স্যারের ব্যক্তিগত জিনিষপত্রের মধ্যে নাকি শুধু এক ট্রাক বই ছিলো!
বাসার ড্রয়িং রুমে গিয়ে আমি বসলাম। মাত্র ৩/৪ মিনিটের মধ্যেই স্যার আমার সামনে আসলেন। স্নিগ্ধব্যক্তিত্বের মহীরুহ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমার সামনে, ভাবতেই যেন স্বপ্নের মতো লাগছে। রাশেদ রউফ ভাই এর প্রসঙ্গ টেনে নিজের পরিচয় দিলাম। আমার হাতে কাগজপত্রের ফাইল দেখে বললেন, ‘দাও দেখি কি এনেছো?’ আমার সম্পাদিত সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা ‘অমিতাভ’ এর কয়েকটি সংখ্যা তাঁর হাতে তুলে দিলাম। দুয়েকটা উল্টিয়ে দেখলেন আর বললেন, ‘ভালো তো, চট্টগ্রাম থেকে এটি বের হচ্ছে’ এরই মধ্যে আমার আসার উদ্দেশ্য জানালাম এবং পাণ্ডুলিপি দিলাম। বললাম আমার নিজের প্রকাশিতব্য বইয়ের একটা ভূমিকা আপনাকে লিখে দিতে হবে। তিনি কিছুক্ষণ আমার লেখাগুলো দেখলেন। অতি সহজেই বুঝেছেন, আমার লেখাগুলো কি ধরনের? বললেন, ‘শ্যামল তোমার লিখা তো খারাপ না, ভালোই। তবে এগুলো ক্রিয়েটিভ লিখা, আমি এর ভূমিকা লিখার চাইতে তুমি একজন ক্রিয়েটিভ রাইটার এর কাছ থেকে ভূমিকা লিখিয়ে নিতে পারো। আমি এ ধরনের রচনার ভূমিকা লিখতে অভ্যস্ত না’। বললাম, স্যার আপনি কার কাছে যেতে বলছেন? তিনি বললেন, ‘তুমি ইমদাদুল হক মিলন কিংবা আনিসুল হকের কাছে যেতে পারো। তারা যদি সময় দেয় তবে ভাল হবে’। সে যাই হোক, আনিসুজ্জামান স্যার সেদিন ২০ মিনিটের সাক্ষাত শেষে আমাকে ফিরিয়ে দিলেও মোটেও হতাশ হইনি। কারণ, তিনি বই এর ভূমিকা লেখায় অপারগতা প্রকাশ করলেও অন্তত তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি, আমার লেখার স্বীকৃতি পেয়েছি, যা আমার জন্য বড় পাওয়া। অথচ সে সময় পত্র-পত্রিকায় আমার খুব একটা বেশি লেখালেখি করা হয়ে ওঠেনি। মিতভাষী, পরিমিতিবোধসম্পন্ন একজন উদার চিত্তের অধিকারী ব্যস্ত এই মানুষের বেশিক্ষণ মূল্যবান সময় নষ্টের ধৃষ্টতা না দেখিয়ে বিদায় নেয়ার প্রাক্কালে বললাম, স্যার একদিন চট্টগ্রামে আমাদের কোন অনুষ্ঠানে আপনাকে পাওয়ার আশা করছি। বললেন, ‘শরীর-স্বাস্থ্য ভাল থাকলে যাবার চেষ্টা করবো অবশ্যই’। এরপর কয়েকবার তাঁর সাথে ফোনে যোগাযোগ আমার হয়েছিল। যে যাত্রায় নিজের একটা বই বের করতে উঠে-পড়ে লাগলেও দুঃখের বিষয় নানা সমস্যায় আজো আমার সেই বই বের করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আর আনিসুজ্জামান স্যারকেও আমাদের কোন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর সুযোগ হয়নি। মনের মধ্যে এই আক্ষেপটা আমার রয়েই গেলো যা আর কোনদিন পূরণ হবার নয়। উল্লেখ্য প্রথমবারই স্যারের সান্নিধ্যে শিখেছি, ফলবান বৃক্ষ নত হয় এবং তার কোন আমিত্ব থাকতে নেই! প্রথম সাক্ষাতেই আমি বুঝেছি, তাঁর মধ্যে নেই কোন অহমিকা বা নেই নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখার প্রবণতা। অথচ দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবি, একজন পুরোদস্তুর ব্যস্ত সময়ের কান্ডারি আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষকে এড়িয়ে যেতে পারতেন, বাসায় দেখা করার অনুমতি নাও দিতে পারতেন।
পরের বছরে শেষ যে-বার স্যারের সাথে যখন দেখা হয় তখন বললাম. স্যার আমাকে চিনেছেন, আপনার বাসায় দেখা করেছিলাম বই প্রকাশের ব্যাপারে। চোখে স্নেহভাজনের অনুনয়, সাথে সাথেই বললেন, ‘হুমম মনে পড়েছে, ভাল আছো?’ ২০০৮ সালের ২৭ জানুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা এর কনফারেন্স লাউঞ্জে ছিল প্রথিতযশা সাহিত্যিক-সাংবাদিক বিমলেন্দু বড়ুয়ার ১ম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণ সভা। সাংবাদিক বিমলেন্দু বড়ুয়া মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে আনিসুজ্জামান স্যার প্রধান অতিথি ছিলেন। আমি সেই শোকসভায় উপস্থিত থেকে প্রয়াত বিমলেন্দু বড়ুয়ার জীবনী পাঠ করি। অনুষ্ঠান শেষে একান্ত আলাপচারিতায় আমি তাঁকে কিছু প্রশ্ন করেছিলাম। তন্মধ্যে চট্টগ্রামের সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘চট্টগ্রামে সাহিত্যচর্চা বা লেখালেখি করছেন অনেকেই আছেন। অনেকেই স্বপ্রতিভায় উদ্ভাসিত হচ্ছেন, তবে উপন্যাস লেখকের খুব অভাব, উপন্যাস চর্চাটা সেভাবে হয়ে ওঠেনি’। তাঁর মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে স্নেহঘন দৃষ্টিতে আমার কাঁধে হাত রেখে কথাগুলো বলছিলেন, আমিও তন্ময় হয়ে তাঁর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে শুনছিলাম। অথচ সেদিনের পর তাঁর যে আর সান্নিধ্য পাবো না, তা ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করিনি।
তাঁকে দেখে সবসময় মনে হয়েছে একজন আপাদমস্তক মানুষ। তাঁর অসাধারণ রুচিতে, বাকসংযমে, পরিমিতিবোধে, স্নিগ্ধব্যক্তিত্বে, স্নেহময় সম্বোধনে, স্বভাবমাধুর্যে প্রথম পরিচয়ের দিন থেকেই জেনেছি তিনি আমার আত্মজন। মনে হচ্ছে আত্মার একটি অংশ বুঝি এখন আর নেই।
এ কথা সত্য যে, পলিমাটির এই ছোট্ট বদ্বীপে আমাদের অভিভাবক হয়ে ওঠা বিরলপ্রজ এ মানুষটির মত মানুষের জন্ম আর হবে না! তাঁর মৃত্যু একটি গৌরবময় অধ্যায়ের অবসানের সংকেতবহ। তাঁর সৃষ্টি, তার অনুকরণীয় আদর্শ এক অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে অনন্তকাল এই বিপুলা পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে থাকা বাঙালির কাছে। স্যার যেখানেই থাকুন ভাল থাকুন, ভক্তিপ্রণত চিত্তে আপনাকে জানাই অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।
লেখক পরিচিতি : সংস্কৃতিকর্মী, প্রাবন্ধিক ও গীতিকার। সম্পাদক ও প্রকাশক, ‘অমিতাভ’