নিত্যদিনের শিল্পীত যাপনে নিপুণ অভিনেতা সনজীব বড়ুয়া

0
30

চট্টগ্রামের মঞ্চের নিপুণ অভিনেতা সনজীব বড়ুয়া– নিত্যদিনের শিল্পীত যাপনে বিনয়ে বিনম্র তিনি বিমুগ্ধ বক্তা

ইউসুফ ইকবাল

সনজীব বড়ুয়া চট্টগ্রামের শিল্পসাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিবিধ অভিধায় চিহ্নিত হলেও তিনি মূলত নাট্যজন। তাঁর ধ্যান জ্ঞানের কেন্দ্রে রয়েছে নাটক। নাট্যাঙ্গনকে কেন্দ্র করেই তাঁর প্রব্রজ্যা। অভিনয় তাঁর জীবন সাধনা। চরিত্র নির্মাণের মধ্যে তিনি খুঁজে পান নৈর্বাণিক সুখ। গত পঞ্চাশ বছর ধরে এ-নগরীর নবনাট্য আন্দোলনে নাটকের রচনা, নির্মাণ, প্রদর্শন, সম্মিলিত কর্মসূচি বাস্তবায়ন সহ নাটকের প্রতিটি পর্বের কর্মে, অনুশীলনে তিনি যুক্ত ছিলেন। নাটকের সাংগঠনিক কর্ম, স্থানীয় ও জাতীয় মোর্চার নেতৃত্ব, নাটক ও নাট্যান্দোলন নিয়ে বৌদ্ধিক চর্চা, নাট্যরচনা, নির্দেশনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও মঞ্চের নিপুন অভিনেতা হিসাবে নাট্যাঙ্গনে তিনি সবিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন।

চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গনে সনজীব বড়ুয়া সেই অনিবার্য নাট্যকণ্ঠ যিনি স্বাধীনতোত্তর ফলবান শিল্পশস্য হিসাবে পরিচিত গ্রুপ থিয়েটার চর্চার উন্মেষকালের একজন বিশ্বস্ত সাক্ষী ও সারথি। গত পঞ্চাশ বছরের নিরবচ্ছিন্ন নাট্যযাত্রায় তিনি ক্লান্তিহীন স্বাপ্নিক পথিক। বিপুল বৈভবে, বহুমাত্রিক পরিচয়ে বিকশিত হয়েছে তাঁর সৃজন-চিন্তন। নাটকের বিস্তৃত আঙ্গিনায় তিনি বিবিধ বিষয়ের শিল্পিত কারিগর। উন্মেষকাল থেকেই তিনি নাটকের অধ্যয়ন, আলোচনা, রচনা, নির্মাণ ও নানা নাট্যকর্মকাণ্ডের একাগ্রচিন্তক ও পর্যবেক্ষক। চট্টগ্রামের নাট্যচর্চা বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজকের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। প্রতিটি বাঁক পরিক্রমায় রয়েছে তাঁর অবলোকন ও অংশগ্রহণ। নাট্যঙ্গনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা, দুর্ঘটনা, প্রত্যাশা প্রাপ্তিসহ অজস্র কর্মসূচির আদ্যোপান্ত তিনি স্বতস্ফূর্তভাবে তুলে ধরেন সতীর্থ তরুণদের কাছে। তাঁর স্মৃতি ও শ্রুতির বিশ্বস্ততার কারণে চট্টগ্রামের নাট্যচর্চার মৌখিক ইতিহাস ও বিবিধ প্রামাণ্য তথ্যসূত্রের মান্য আকর হিসাবে তিনি একজন নির্ভরযোগ্য উৎস। এসব ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত সূত্র হিসাবে তিনি ব্যাপকভাবে উদ্ধৃত। বাংলাদেশের প্রথম পথনাটকের তিনি অন্যতম অভিনেতা। প্রথম দিনেই নাটকটির পর পর ছয়টি প্রদর্শনীতে অভিনয় করে তিনি চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গনের ঐতিহাসিক এক সুবর্ণ মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে আছেন।

সনজীব বড়ুয়া মঞ্চের সুদক্ষ অভিনেতা। পরিশীলিত উচ্চারণে বচনে বাচনে তিনি বিশুদ্ধ। অভিনয়ের বাচিক উৎকর্ষতায় তিনি অনন্য। সংলাপের যৌক্তিক প্রক্ষেপনে তিনি যত্নবান। আখ্যানে বর্ণিত চরিত্রের আবেগ ও অবয়ব তিনি সহজেই নিজের মাঝে ধারণ করেন। স্বঃতস্ফূর্ত ও স্বকীয় অভিনয় দক্ষতায় ধারণকৃত চরিত্রের আচরণকে তিনি ফুটিয়ে তোলেন অপূর্ব নিপুনতায়। তখন আখ্যানের চরিত্র অদৃশ্য কল্পনা ভেঙ্গে প্রাণবন্ত হয়ে জেগে ওঠে মঞ্চের জীবন্ত বাস্তবতায়। অভিনয়কলায় তিনি স্বকীয়তায় প্রজ্জ্বলিত প্রতিভা। তিনি টেকস্টের অদেখা চরিত্রের নিপুন নির্মাতা। চট্টগ্রামের মঞ্চে অজস্র নাট্যকর্মী অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। কিন্তু, সনজীব বড়ুয়া চট্টগ্রামের সেই নাট্যজন যিনি দীর্ঘ অভিনয়জীবনে বিচিত্র চরিত্রের রূপদান করে নিজের নামের সাথে ‘অভিনেতা’ শব্দটি অলংকার হিসাবে যুক্ত করতে সমর্থ হয়েছেন। তাঁর উচ্চারণে সংলাপ প্রাণ পায়। তাঁর নিখুঁত বাচিক ও আঙ্গিক অভিনয়ে চরিত্র বাস্তব হয়ে ওঠে। মঞ্চে সনজীব বড়ুয়ার অভিনয় দর্শকের মনে অনির্বচনীয় মুগ্ধতা সৃষ্টি করে– যা মঞ্চের বাস্তবতাকে অবলম্বন করে পুরো নাটক শৈল্পিক উচ্চতায় নিয়ে সহজে পৌঁছে যায় দর্শকের মনে। অভিনয়ে তিনি বিশেষ কোনো দলে সীমাবদ্ধ থাকেননি। বিভিন্ন দলে, বিবিধ উদ্যোগে নির্মিত নাট্যকলায় তিনি পারঙ্গম অভিনয় প্রতিভা প্রদর্শন করেছেন।

নাট্যনির্মাণে কুশলী একজন নির্দেশকও তিনি। বাস্তববাদী ঘরাণার নাটককে তিনি নির্দেশনার জন্য বেছে নেনে। সহজ নির্মাণরীতির কারণে তাঁর নাটকে দর্শক সহজে একাত্ম হতে পারে। নাট্যরচনায়ও তাঁর ভূমিকা রয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি সমকাললগ্ন– সমকালীন বাস্তবতার ভাষ্যকার। ব্যক্তির ক্ষত, সমকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট, মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রভৃতি বিষয় তাঁর নাটকে ঘুরেফিরে এসেছে।

সনজীব বড়ুয়া চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গনে একজন পরিচ্ছন্ন ও মেধাবী নাট্যচিন্তক। তাঁর পরিচ্ছন্ন শিল্পবোধ শুধু পরিবেশনা শিল্পে নয়– তা প্রতিফলিত হয় তাঁর সংঘচিন্তনে, নিত্যদিনের যাপিত জীবনে– আচরণে, আভরণে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি সজ্জন, সদালাপী। বিনয়ে বিনম্র তিনি বিমুগ্ধ বক্তা। এই খ্যাতিমান নাট্যজন কালের বর্তমান প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছেন নাট্যাঙ্গনের অনিবার্য ব্যক্তিত্বরূপে– গর্বিত অবস্থানে– তরুণ নাট্যকর্মীদের শ্রদ্ধার অলংকৃত আসনে।

লেখক : শিক্ষাজীবী, এমএ (বাংলা), এমফিল, পিএইচডি (নাট্যসাহিত্য), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here